আজ শনিবার, ১৫ই আষাঢ়, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৯শে জুন, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

‘অটো পাস’ আর ‘গায়েবি’ ভোটের আশায় তৈমুর সমর্থকেরা

প্রথম আলো থেকে নেয়া:

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হঠাৎ করেই আলোচনায় আসেন বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত তৈমূর  আলম খন্দকার। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাবেক এই উপদেষ্টা ‘কিংস পার্টি’ খ্যাত তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়ে দলটির মহাসচিব বনে যান। পরবর্তী সময়ে দলটির হয়ে রাজধানী লাগোয়া নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসন থেকে নির্বাচন করছেন। তৈমুর আলম সোনালী আঁশ প্রতীক নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

তৈমুরের কর্মী-সমর্থকেরা মনে করছেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে ‘সরকারকে সহায়তা’ করায় আওয়ামী লীগ তৈমুর আলমকে ‘অটো পাসে’ (বিনা ভোটে) সংসদ সদস্য বানাবে। কেউ কেউ আশায় আছেন, ‘গায়েবি’ ভোটে জিতবেন তিনি। কেউ কেউ আশা করছেন, নৌকার বিরুদ্ধে বিএনপির সমর্থকেরা তৈমুর আলমকেই ভোট দেবেন।

তবে বিএনপির নারায়ণগঞ্জের নেতারা বলছেন, সরকারের ‘পাতানো নির্বাচনে’ অংশ নিয়ে তৈমুর আলম বিএনপির বিশ্বাস ভেঙেছেন। বিএনপির লোকজন নৌকাকে সমর্থন করলেও তৈমুরকে সমর্থন করবে না।

গতকাল বুধবার বিকেলে রূপগঞ্জের কাঞ্চন পৌরসভা এলাকায় গণসংযোগ করেন তৈমুর আলম। বিকেলে কেন্দুয়া এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, ৭০-৮০ জনের একটি মিছিল নিয়ে সোনালী আঁশ প্রতীকে ভোট চাচ্ছেন তিনি। মিছিলে অংশ নেওয়া লোকজনের অধিকাংশই কিশোর, বাকিরা বয়োবৃদ্ধ। হাতে গোনা কয়েকজন তরুণ-যুবক। তৈমুর আলমের স্ত্রী ছাড়া মিছিলটিতে অন্য কোনো নারী ছিলেন না।

কথা হলো ষাটোর্ধ্ব মোক্তার হোসেনের সঙ্গে। জানালেন, কাঞ্চন পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির এক সময়ের যুগ্ম সম্পাদক তিনি। তাঁর ভাতিজা নারায়ণগঞ্জ আদালতের আইনজীবী দেওয়ান আশরাফুল আলমের অনুরোধে তৈমুর আলমের সঙ্গে নির্বাচনে নেমেছেন। আশরাফুল আলমের বাবা দেওয়ান নুরুল আমিন, ৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাবেক সভাপতি ইসমাইল হোসেন ও তাঁর যৌথ প্রচেষ্টায় মিছিলের আয়োজন। তাঁরা দুজন ছাড়া বিএনপির আর কোনো নেতা-কর্মীকে মিছিলে পাচ্ছেন না বলেও জানান মোক্তার হোসেন।

মোক্তার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তৈমুর আলম বিআরটিসির (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন) চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় ইসমাইল হোসেনের বোনের ছেলেকে চাকরি পাইয়ে দিয়েছিলেন। ইসমাইল তখন তৈমুর আলমের সঙ্গে বিএনপির রাজনীতি করতেন। পরে দল ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিলেও কোনো পদ না পেয়ে এখন তৈমুর আলমের নির্বাচন করছেন।

দেওয়ান নুরুল আমিনের কাছে তৈমুর আলমের ভোটের মাঠ কেমন জানতে চাইলে তাঁর সহাস্য উত্তর, ‘মাঠ তো নাই।’ এরপর নিজের কথার ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন, ‘নতুন দল তো, লোক নাই। এখন উনি (তৈমুর আলম) না পাবেন বিএনপির ভোট, না পাবেন আওয়ামী লীগের ভোট।’ তিনি বলেন, তাঁর ছেলে তৈমুর আলমের সহায়তায় আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। সে জন্যই তিনি মিছিলের আয়োজন করেছেন। মিছিলে ৫০ জন লোক আনতে তাঁদের প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। সেই টাকা তৈমুর আলমই দিয়েছেন। তাঁর পরিবার ও স্বজনেরা তৈমুরকেই ভোট দেবেন বলে জানালেন।

নুরুল আমিনের বিশ্বাস, তৈমুরকে সরকার ‘অটো পাসে’ (বিনা ভোটে) জিতিয়ে দেবে। আর তা না হলে তৈমুর হারবেন। ভোটে হারলেও সরকার তৈমুর আলমকে বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব দিয়ে ‘সম্মানিত’ করবে আশা নুরুল আমিনের। নুরুলের কথায় সায় দিয়ে মোক্তার হোসেন বলেন, ‘ইশারা ছাড়া এমনি এমনি উনি (তৈমুর) ভোটে নামেন নাই।’

তবে এমনটা মনে করেন না তৈমুর আলমের গণসংযোগের নিয়মিত মুখ মো. শামীম। তৈমুরের এই নিকটাত্মীয় জানান, প্রচারণার শুরু থেকেই তিনি তৈমুর আলমের গাড়িবহরে থাকছেন। তাঁর বিশ্বাস, বিনা ভোটে নয়, বরং ‘গায়েবি’ ভোটেই তৈমুর আলম জয়ী হবেন। দৃশ্যমান কোনো প্রচারণায় না থাকলেও বিএনপির লোকজন নীরবে তৈমুর আলমকেই ভোট দেবেন।

কাঞ্চন বাজারে গণসংযোগের সময় বাজারের ফার্মেসির দোকানদার মো. মোস্তফার সঙ্গে কথা হয়। নিজেকে বিএনপির কর্মী পরিচয় দিয়ে মোস্তফা বলেন, ভোট দিতে তিনি কেন্দ্রে যাবেন না। তাঁর দোকানে হওয়া ভোটের আলাপ থেকে তিনি বুঝতে পারছেন, জাতীয়ভাবে তৈমুর আলমের একটা পরিচিতি তৈরি হলেও ভোটের মাঠে তাঁর ভিত দুর্বল।

এর আগে মঙ্গলবার দুপুরে গাড়িবহর নিয়ে উপজেলার চনপাড়া পুনর্বাসনকেন্দ্রে যান তৈমুর আলম। তখন চনপাড়ার বাইরে বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া সোহরাব হোসেন ও ফাতেমা আক্তারের নেতৃত্বে ১২-১৫ জনের একদল কিশোর ও তরুণ তৈমুর আলমকে বরণ করে নেন। চনপাড়ায় গণসংযোগ শেষে তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, তাঁর সঙ্গে রূপগঞ্জের সর্বস্তরের জনগণ আছেন।

চনপাড়া বিএনপির জ্যেষ্ঠ একজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, সোহরাব, ফাতেমা ছাড়াও চনপাড়ায় বিএনপির সাবেক কর্মী আবদুল মালেক, ইদ্রিস আলী ও কাজল গাজী তৈমুরের পক্ষে এলাকায় কাজ করছেন। তাঁরা বিএনপির সময় তৈমুরের মাধ্যমে উপকারভোগী। কাজলের ছেলেকে বিআরটিসিতে চাকরি পাইয়ে দিয়েছিলেন তৈমুর। চনপাড়ায় বিএনপির লোকজন নৌকাকে ভোট দিলেও তৈমুরকে ভোট দেবেন না।

চনপাড়ায় তৈমুরের মিছিলে আসা কিশোরদের মধ্যে দুজনের সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তাদের একজন নবম শ্রেণিতে পড়ে, অন্যজন রিকশাচালক। কাঞ্চনের কেন্দুয়া খালপাড় এলাকার বাসিন্দা দুই কিশোর জানায়, প্রায় আট দিন ধরে তারা তৈমুর আলমের গাড়িবহরে থাকে। বিনিময়ে জনপ্রতি ৫০০ টাকা ও তিন বেলা খাবার পায়। কিশোরদের দাবি, সিএনজিচালক এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে তারা ১২-১৫ জনের একটি দল নির্বাচনী প্রচারে যুক্ত হয়েছে। প্রতিদিন পিকআপ ভ্যানে কেন্দুয়া গাজী স্টেডিয়াম থেকে তাদের সবাইকে নিয়ে আসা হয়।

তৈমুর আলমের স্বজনের ছেলে দিপু ভূঁইয়াও তাঁর গাড়িবহরে নিয়মিত থাকেন। সঙ্গে থাকেন দিপুর ১১ বছরের কিশোর ভাই। দিপু জানান, প্রতিদিন ১৩টি কালো রঙের হাইয়েস গাড়িতে করে তাঁরা বিভিন্ন এলাকায় প্রচারে যান। প্রতিটি গাড়িতে ১৪ জন করে থাকেন। অধিকাংশই স্বজন। স্বজনের বাইরে যাঁরা আসেন, তাঁদের ৫০০ টাকা করে দিতে হয়। স্বজনদের বাইরে তৈমুরের প্রচারণায় লোক আসছে না বলে আক্ষেপ করেন দিপু ভূঁইয়া।

এরই মধ্যে গণসংযোগের সময় কয়েকজন ভোটারের সঙ্গে কথা বলেন তৈমুর আলম। ভোটারদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘যারা জিয়ার লগে দলডা করলো হেরা কেউ তো দলডা করতে পারল না। আমিও একই কারণে করতে পারি নাই। রাজনীতি করি গোলামী করুম না। আওয়ামী লীগে যাই নাই। বিএনপিই করছি। তৃণমূল বিএনপি।’ এ সময় তিনি ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে তাঁকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান। ভোটারদের উদ্দেশে বারবার বলেন, আগামী সংসদে তৃণমূল বিএনপিই হবে প্রধান বিরোধী দল।

তৈমুর আলম পরে মিছিল করে চনপাড়ার বিভিন্ন গলিতে ভোট চান। মিছিলের সামনে থেকে হ্যান্ডমাইকে বারবার বলা হয়, ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ও ভোটের অধিকার ফিরে পেতে তৈমুর ভাইকে সোনালী আঁশ মার্কায় ভোট দিন।’ এমন আহ্বানে তৈমুরকে কেউ হাত উঁচিয়ে সালাম দেন। কেউ কেউ ভোটের আশ্বাস দেন। আবার কেউ কেউ মুখের ওপর বলে দেন, ‘প্রয়োজনে নৌকাকে ভোট দেবেন তবুও তৈমুরকে না।’

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ